অপরিকল্পিত উন্নয়নে বিপর্যস্ত পরিবেশ
শিল্পায়ন আধুনিক সভ্যতার এক অনবদ্য উপাদান। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ, নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন শিল্পায়নকে করছে আরও বেগবান। নতুন কলকারখানা স্থাপনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। উন্নয়ন অগ্রযাত্রা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেও চারদিকে পড়ছে এর ক্ষতিকর প্রভাব। অতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে বায়ু, অপরিশোধিত বর্জ্যে বিষাক্ত হচ্ছে নদী ও জলাশয়। সুপেয় পানির আধারগুলো অযোগ্য হয়ে উঠছে দিন দিন। সেই সঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে জলজ জীববৈচিত্র্য। বিপন্ন হচ্ছে দেশী প্রজাতির বিভিন্ন মাছ ও অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ। এছাড়া রাসায়নিক বর্জ্য মানুষের শরীরে ঢুকে সৃষ্টি করছে ক্যান্সার, স্নায়ুবিক বৈকল্য, চর্মরোগ, হাঁপানিসহ নানা কঠিন ও জটিল রোগ। অপরিকল্পিত নগরজীবনে ব্যবহৃত নিষিদ্ধ পলিথিন, প্লাস্টিকসামগ্রী ও গৃহস্থালি বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। যত্রতত্র পলিথিন ফেলার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ধ্বংস হচ্ছে মাটির উর্বরাশক্তি।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে আলোচনার ঝড়। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্যই পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, গাছপালা ও বনভূমি উজাড়, কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার, ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, যানবাহন, ইটের ভাটা ও কলকারখানা থেকে নিঃসরিত কালো ধোঁয়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর জলবায়ুর সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস যেন দেশটির নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের রাস্তা-ঘাট, বাঁধ, সেতু, বন্দরসহ বিভিন্ন স্থাপনা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে উন্নয়ন হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। অপরিকল্পিত বাঁধের ফলে নাব্য হারাচ্ছে নদী। চর পড়ে নষ্ট হচ্ছে জলজ পরিবেশ। কৃষিকাজ দিন দিন পরিণত হচ্ছে চ্যালেঞ্জিং পেশায়। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে সেচের অভাবে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবাদি জমি পরিণত হচ্ছে অনাবাদিতে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিচ্ছে মরুকরণ। শুকনো মৌসুমে দেখা দিচ্ছে পানির সংকট। আবার বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে সুন্দরবন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে ওই অঞ্চলের মানুষ। কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন অদূরদর্শীর পরিচায়ক। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাওয়া গেলেও পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অপূরণীয়। বাঁধের কারণে প্রায় ৫৪ হাজার একর জায়গা পানির নিচে তলিয়ে যায়। যার মধ্যে রয়েছে সরকারি বনসহ অন্যান্য বনাঞ্চল। এতে প্রায় ১ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়ে পড়ে। বিপন্ন হয় এলাকার জীববৈচিত্র্য। পরিবেশের ক্ষতি হবে কী হবে না তা না ভেবেই মানুষ আগে উন্নয়নমূলক কাজ করত। বর্তমানে সে ধ্যান-ধারণা পাল্টেছে। এখন কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের আগে পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখা হয়। তাই পরিবেশবান্ধব নগরায়ন, শিল্পায়ন, পাশাপাশি যানবাহন ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনেও পরিবেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। শহরের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে গ্রামের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। ফসলি জমির সুষম ব্যবহার, পরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে উন্নয়নভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
পরিবেশের সার্বিক অবস্থা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক সামাজিক অবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর। পরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যবস্থা যেমন মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে তেমনি হয় পরিবেশবান্ধব। অপরদিকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন সাময়িকভাবে মানুষের উপকারে এলেও পরিণামে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই পরিবেশ এবং মানুষ উভয়ের জন্যই প্রয়োজন সুষম উন্নয়ন ব্যবস্থা।
Collected:
http://www.jugantor.com/