অভিমানী প্রকৃতি
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ধূলায় ধূসর রুক্ষ, পিঙ্গল জটাজাল নিয়ে ঋতুচক্রের শুরুতেই আর্বিভাব ঘটে গ্রীষ্মের। জনজীবনের রুক্ষতাই গ্রীষ্মের বৈশিষ্ট নয়। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ প্রভৃতি রসালো ফল অকৃপণ হাতে দান করে এই গ্রীষ্মকাল। আর এ কারণে গ্রীষ্মকালের অন্য নাম হলো মধুমাস। এরপর আকাশে জমে ওঠা মেঘের স্তুপ আমাদের কাছে পৌঁছে দেয় বর্ষার আগাম বার্তা। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত প্রকৃতিকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তুলতে আসে বর্ষাকাল। এরপর শুভ্র মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলা দেখে মন মেতে ওঠে শরতের অনাবিল সৌন্দর্যে। শরৎ এর প্রকৃতি মেতে ওঠে শিউলি, কামিনী, জুঁই প্রভৃতি ফুলের সৌরভে । সবুজ ফসলের মাঠে ঢেউ খেলে মৃদুমন্দ বাতাস । শরৎ এর সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে কবিগুরু বলে ওঠেন- ‘আজিকে তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে’। শরতের রূপময়তাকে বিদায় জানিয়ে বৈরাগ্যের ঢঙে আসে হেমন্ত। সর্ষে ফুলে ছেয়ে যায় মাঠের পর মাঠ। অন্যদিকে থাকে, সোনালি রঙের পাকা ধান। তখনই মনে ভেসে ওঠে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের দুটি লাইন- ‘ওমা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে, কী দেখেছি মধুর হাসি।’ হেমন্ত বিদায় নিতে না নিতেই ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে উত্তরের হাওয়ায় ভেসে আসে শীত। নানা রকম শাক-সবজি, ফল ও ফুলের সমারোহ শীতকে জনপ্রিয় করে তোলে। একদিকে শীতের কষ্ট অন্যদিকে ফুল-ফল-ফসল ও পিঠা-পুলির সমারোহে বাংলাদেশের শীতের আনন্দ রোমাঞ্চকর। সবশেষে রাজার বেশে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। দক্ষিণা মৃদু বাতাসে প্রকৃতি ও মনে দোলা লাগে। কোকিলের কুহুতানে প্রকৃতি যেন জেগে ওঠে। শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অর্জুন প্রভৃতি রঙ-বেরঙের ফুলে বসন্ত সাজে অপার সৌন্দর্যে।
কিন্তু এখন কি আমরা সত্যিই ষড়ঋতু উপভোগ করি? বছরের প্রায় সাত থেকে আট মাস গরম থাকে, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে শুধু গরম বললে ভুল হবে৷ কয়েক মাস তো থাকে তীব্র গরম৷ কোনো রকমে বছরে দুই-তিন মাস তাপমাত্রা একটু কম থাকে, যার মধ্যে দুই মাসকে আমরা বলি শীতকাল৷ আর বছরের মাঝখানে কারণে-অকারনে শুরু হয় বৃষ্টি, যাকে আমরা নাম দিয়েছি বর্ষাকাল৷ তাহলে শেফালি শোভিত শরৎ, কদম ফোটা বর্ষা বা কোকিলের কুহু কুহু ডাকে মুখরিত ঋতুরাজ বসন্ত কোথায় গেল? প্রকৃতির ওপর অপ্রাকৃতিক আচরণের কারণেই কি প্রকৃতির এই কঠোরতা? প্রকৃতিকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। নাহলে ঋতুচক্র তার বৈচিত্র্য হারাবে। প্রশ্ন হল- আমরা কিভাবে প্রকৃতির গতিতে আঘাত হানছি? গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া দূষিত করছে বাতাস। কলকারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য মাটি-পানিকে দূষিত করছে। উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে পাল্লা দিয়ে নিঃসরণ করে যাচ্ছি কার্বন ডাই অক্সাইড যা বাড়িয়ে দিচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। ফলে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে জলবায়ু। প্রকৃতিকে আঘাত করতে করতে আমরা বিষিয়ে তুলেছি। অভিমান করে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছে শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত। কিন্তু এভাবেই চলতে থাকলে প্রকৃতি তার আপন স্বকীয়তা হারাবে। যার ফলশ্রুতিতে ঋতুচক্রের আরও বড় পরিবর্তন হতে পারে যা পরিবেশ, প্রকৃতি কিংবা মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাড়াবে।
পরিবেশটাতো আমাদের, তাই এর সংরক্ষণও আমাদেরই করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? ইচ্ছামত গাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বৃহৎ নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ তৈরি করা বন্ধ করতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কল কারখানায় উৎপন্ন বর্জ্য নদী কিংবা খালে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণগুলো যেহেতু আমরা জানি, সেহেতু এর প্রতিকার কঠিন কিছু নয়। দরকার শুধু জনসচেতনতা। পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরূপ ফল যে কতটা ভয়াবহ এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের একটু সচেতনতাই বাঁচাতে পারে আমাদের প্রকৃতিকে। আসুন, সচেতন হই পরিবেশ বাঁচাই।
মোঃ নাজিমুজ্জামান
প্রোগ্রাম এসোসিয়েট
এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোসাল ডেভেলপমেন্ট ওরগানাইজেশন-এসডো