ম্যানগ্রোভ ভিত্তিক মৎস্য চাষে বাঁচাবে পরিবেশ, বাঁচাবে কৃষক
ঢাকা, ২ জানুয়ারী, ২০২১: গ্রীষ্মমন্ডলীয় উপকূলীয় অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উৎপাদনশীল পরিবেশের মধ্যে অন্যতম। এসকল ম্যানগ্রোভ বনের কার্বন সংরক্ষণ ক্ষমতা ব্যাপক যা বিশ্বের জলবায়ু স্থিতিশীল করা ও উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি অসংখ্য প্রজাতির মাছের প্রজনন ও পালনক্ষেত্র যা উপকূলীয় মৎস্য সম্পদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিবেশ ব্যবস্থা গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্নিঝড়ের তীব্রতা কমিয়ে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করে। তবে সম্প্রতিকালে ম্যানগ্রোভ উৎপাদনশীল প্রতিবেশসমূহ তীব্র ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ২০ শতাংশ ম্যানগ্রোভ হ্রাস পেয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি হলো চিংড়ি চাষের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার।
ম্যানগ্রোভ সুরক্ষার অভাবে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবন (পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন) উপকূলে আঘাত হানে, বহু লোকের প্রাণহানি ঘটায় এবং বাড়িঘর ও ফসলের ক্ষতি করে। এই ধ্বংসের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থান হারিয়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। জীবিকার প্রয়োজনে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে উপকূলীয় এলাকার অধিক জনগণ। চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের আর একটি সমস্যা হলো বিদ্যমান হ্যাচারি প্রজননের জন্য জীবাণুমুক্ত চিংড়ি ও কাঁকড়ার পোনার চাহিদা মেটাতে পারে না। যার ফলে, সুন্দরবন থেকে প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি ও কাঁকড়ার পোনা আহরণ করা হয়। একইসাথে অটেকসই বনজসম্পদ আহরণ স্থানীয় মূল্য শৃঙ্খলের একটি অংশ যা কতিপয় জনগণকে সম্মানজনক উপার্জনে সহায়তা করে। এছাড়া বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের মধ্যসত্ত্বভোগী রয়েছে, যারা চিংড়ি ও কাঁকড়ার মূল্য শৃঙ্খলের সাথে জড়িত থেকে চাষীদের অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং সরবরাহ চেইনে তাদের অবস্থান সীমাবদ্ধ করে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ফেডারেল মিনিস্ট্রি অব ইকোনমিক কোঅপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট, জার্মানি (বিএমজেড) এর আর্থিক সহায়তায় জার্মানির গ্লোবাল ন্যাচার ফান্ড, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বেডস্) ও ভারতের ন্যাচার এনভায়রনমেন্ট এন্ড ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি (নিউজ) চিংড়ি শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে প্রচলিত চিংড়ি উৎপাদন ও ব্যবসায় পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ম্যানগ্রোভ প্রতিবেশ সুরক্ষা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জার্মানি, বাংলাদেশ ও ভারত এ তিন দেশের অংশগ্রহনে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে যার আওতায় থাকছে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ উন্নয়ন। বাংলাদেশ অংশের সমন্বয় করছেন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বেডস্) এর প্রধান নির্বাহী জনাব মোঃ মাকছুদুর রহমান।
এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো আইএমএ অর্থাৎ ম্যানগ্রোভ ভিত্তিক মৎস্য চাষের মাধ্যমে চাষীদের জীবনমান উন্নয়ন। খুলনা বিভাগের খুলনা জেলার দাকোপ ও কয়রা উপজেলা, বাগেরহাট জেলার মোংলা ও রামপাল উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলা থেকে শ্যামনগর উপজেলা এই প্রকল্পের প্রকল্প এলাকা। এসকল অঞ্চল সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চল এবং এখানকার অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করে। দারিদ্রতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে তারা তাদের জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ম্যানগ্রোভ রক্ষার্থে ও কৃষকদের তাদের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার সঠিকপথ করে তোলাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এমএসপি প্রকল্পের প্রত্যক্ষ কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠী হলো ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন চিংড়ি চাষী। ভারত ও বাংলাদেশের চিংড়ি সরবরাহের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ পরোক্ষ কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠী। পরোক্ষ কাঙ্ক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভিতরে রয়েছে স্থানীয় ঘের কর্মী, মৌসুমী অস্থায়ী ঘের কর্মী (পুরুষ/মহিলা), অনেক ছোট ছোট জমির মালিক যারা তাদের পুকুর/জমি লিজ দেয় (এবং মূল্য নির্ধারণে অংশগ্রহণ করে), জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিংড়ির পোনা সংগ্রহকারী মহিলা ও শিশু এবং গবাদি পশু পালক যারা চিংডির ঘেরে গবাদি পশু পালন করে।
আইএমএ (ম্যানগ্রোভ ভিত্তিক মাৎস চাষ):
সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির সমন্বয়ে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করাকে আইএমএ (ম্যানগ্রোভ ভিত্তিক মৎস্য চাষ) বলা হয়। আইএমএ এর ফলে কোন পরিবেশ দূষণ ঘটে না এবং এর ফলে চিংড়ি ও অন্যান্য সাদা মাছের উৎপাদন ও গুনগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব। চিংড়ি বা মাছ চাষে অতিরিক্ত খাবার ও রাসায়নিক এর প্রয়োজন হয় না। এতে উৎপাদন খরচ সাশ্রয় হয়। রাসায়নিক এর ব্যবহার না করার ফলে চিংড়ি ও মাছ চাষ পরিবেশবান্ধব হয়।
আইএমএ (ম্যানগ্রোভ ভিত্তিক মৎস্য চাষ) এর উদ্দেশ্যঃ
- ম্যানগ্রোভ প্রতিবেশ সংরক্ষণ করা।
- পরিবেশবান্ধব/জৈবিক পদ্ধতিতে মাৎস উৎপাদন করা।
ম্যানগ্রোভ ভিত্তিক চিংড়ি চাষের সুফলঃ
- পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
- অধিক ম্যানগ্রোভ গাছ অধিক কার্বন সংরক্ষণ করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে।
- ঘেরের বেড়িবাঁধে ম্যানগ্রোভ গাছ লাগালে তা বেড়িবাঁধ মজবুত ও মাটির ক্ষয় রোধ করে।
- নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের ফলে ঘের কয়েকবছর পর দূষিত হয়ে পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। ম্যানগ্রোভভিত্তিক চিংড়ি চাষে অতিরিক্ত খাবার ও রাসায়নিক এর প্রয়োজন হয় না। তাই পরিবেশ দূষিতও হয় না।
- মৎস্যর গুণগত মান বজায় থাকে।
- এই জৈব পদ্ধততে উৎপাদিত চিংড়ির চাহিদা বিশ্ব বাজারে বেশি থাকায় অধিক দামে বিক্রি হয়, ফলে চাষিরা অধিক মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
এই পদ্ধতিতে চাষের ফলে চাষীরা আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হবে, একইসাথে ম্যানগ্রোভের ভারসাম্য রক্ষা পাবে।
দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষেরই জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল। তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে মাৎস চাষের উন্নতি অতপ্রতভাবে জড়িত। ম্যানগ্রোভ ভিত্তিক চিংড়ি চাষের ফলে চাষীরা একদিকে যেমন তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতে সক্ষম হবে তেমনি সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নতি সাধন হবে।
বিস্তারিত
।