বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণ এবং পরিবেশের উপর তার প্রভাব
প্লাস্টিক অপচনশীল রাসায়নিক দ্রব্য যা পরিবেশে সহজে মিশেনা। তাই পরিবেশের উপর প্লাস্টিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যে প্লাস্টিক আমরা ব্যবহার করে ফেলে দেই, সেই প্লাস্টিক তখন চলে যায় আমাদের ড্রেন, খাল–বিল, নদী–নালা ও সমুদ্রে। এই প্লাস্টিকের শতকরা ২ ভাগ জমা হচ্ছে মহাসাগরে৷ জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব দিনের পর দিন ভয়ংকর রূপ ধারন করছে।
সমুদ্রর ঢেউ এবং সূর্যের আলোর প্রভাবে প্লাস্টিকের পণ্য ধীরে ধীরে টুকরো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়৷ পানি ও অন্যান্য খাদ্যের সাথে একসময় এই মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন জীবের দেহে প্রবেশ করে৷ একসময় ফুড চেইন বিশেষ করে মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক যা মানবদেহে চরম স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটায়।
১৯৫০ সালে পৃথিবীতে প্লাস্টিকের উৎপাদন ছিল মাত্র ২.২ টন। ৬৫ বছর পর, ২০১৫ সালে সে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৮ মিলিয়ন টনে। পৃথিবীতে এখন প্রতি বছর মাথাপিছু ৬০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার হয়৷ উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং জাপানের মত শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এই পরিমাণ মাথাপিছু ১০০ কেজিরও বেশি৷ বাংলাদেশে এ পরিমাণ, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম৷ বেসরকারি সংস্থা ওয়েইস্ট কনসার্নের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু ৩.৫ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করেছে৷ শ্রীলঙ্কাতে এই পরিমাণ ৬ কেজি৷ পাশাপাশি বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্য রিসাইকেল এর হার মাত্র ৯.২ শতাংশ৷
কিন্তু ব্যবহার কম হলেও বাংলাদেশের পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেক । এর পেছনে মুলত তিনটি প্রধান কারন বিদ্যমান।
প্রথমত, অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক খারাপ৷ ফলে প্লাস্টিক, কাঁচ, কাগজ, কাপড় বা পচনশীল দ্রব্য আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনা না করায় অধিকাংশ প্লাস্টিকের মতো অপচনশীল দ্রব্য মিশছে মাটি এবং পানিতে৷
দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতা না থাকায় নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট দ্রব্য ফেলার সংস্কৃতি এখনও বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি৷ ফলে দেশের আনাচেকানাচে বিনাবাধায় ছড়িয়ে পড়ছে প্লাস্টিক৷
তৃতীয়ত, নদী-নালা খাল-বিলের দেশ বাংলাদেশ৷ ফলে পানির অবিরাম প্রবাহ দেশের অধিকাংশ প্লাস্টিক বয়ে নিয়ে ফেলছে সমুদ্রে৷
নতুন এক গবেষণা বলছে, ১৯৫০ সাল থেকে অপরিশোধিত তেল দিয়ে তৈরি হয়েছে ৮.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ এখনও বাসাবাড়ি, গাড়ি বা কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে। আরো ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আর বাকি ৬০ শতাংশ প্লাস্টিকের হদিস মেলেনি। এ হিসেবে মাথাপিছু প্রায় ৬৫০ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক বর্জ্য কোথাও না কোথাও পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে যার বেশিরভাগটাই যাচ্ছে মহাসাগরে। এছাড়া তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় বেশিরভাগ কাপড়েই সিনথেটিক ফাইবারের ব্যবহারও বেড়েছে৷ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে একটি জ্যাকেট একবার ধুলে ১০ লাখেরও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরো মেশে ওয়াশিং মেশিনের পানিতে৷ সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক গবেষণায় দেখা গেছে ওয়াশিং মেশিন থেকে প্রতি বছর ৩০ হাজার টন সিনথেটিক ফাইবার পানিতে মেশে৷
বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোসাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন-এসডো বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৯০ সালে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকসমূহের উপর গবেষণা করে। এই গবেষণার ফলাফল প্রচার তথা জনমত গঠনে ১৯৯২ সালে এসডো সারা দেশব্যাপী এক আন্দোলনের আয়োজন করে। দেশি-বিদেশি সংস্থা ও মিডিয়াও এই আন্দোলনকে সমর্থন দেয়। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এসডোর এই অ্যান্টি- পলিথিন আন্দোলনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দেয়। যার ফলশ্রুতিতে, ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন এবং ব্যবহার নিষিদ্ধের মধ্যে দিয়ে এসডোর দীর্ঘ এক দশকব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রম সফলতা লাভ করে। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করনে জনসচেতনতা তৈরি করতে GAIA“আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক ব্যাগ মুক্তদিবস” পালন করে আসছে। বিশ্বকে সম্পূর্ণরূপে আবর্জনা মুক্ত করতে GAIA সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে “আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক ব্যাগ মুক্তদিবস” উদযাপণে আহ্বান জানায়।
পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পাটের মতো পচনশীল পণ্যের ব্যবহারে উৎসাহিত করছে সরকার। সেই সাথে ছয়টি পণ্য যেমন চাল, গম, সার, চিনি এবং আরো দুটি নতুন পণ্য- হাঁস এবং মাছের খাবার এর মোড়কজাতকরণে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকার এর পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরকেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যা প্লাস্টিক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।
তথ্যসূত্র: ডিডাব্লিউ এবং ডেইলি স্টার নিউজ